শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের ব্রজবাসীদের সঙ্গে মিলন!
শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের ব্রজবাসীদের সঙ্গে মিলন |
কোন একসময়ে কৃষ্ণ এবং বলরাম যখন সুখে-শান্তিতে তাদের মহানগরী দ্বারকাপুরীতে বসবাস করছিলেন, তখন এক বিরল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়, যা সাধারণত ব্রহ্মার একদিন অর্থাৎ কল্পান্তে দৃষ্ট হয়। কল্পান্তে সূর্য বিশাল মেঘে আচ্ছন্ন হয় এবং অবিরাম বর্ষণে নিম্নলোক থেকে স্বর্গলোক পর্যন্ত জলমগ্ন হয়। জ্যোতিষ গণনা অনুযায়ী আগেই জনসাধারণকে এই মহা সূর্যগ্রহণের কথা জানিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই জন্য কুরুক্ষেত্রের সমন্তপঞ্চক নামক তীর্থক্ষেত্রে নরনারী সকলেই সমবেত হতে মনস্থ করে।
ভগবান পরশুরাম একুশবার বিশ্বের সকল ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করে বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন বলেই সমন্তপঞ্চক তীর্থ বিখ্যাত হয়ে আছে। ভগবান পরশুরাম সকল ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করেন, এবং তাদের রক্তস্রোত নদীর মতো প্রবাহিত হয়েছিল। পরশুরাম সমন্তপঞ্চকে পাঁচটি বিরাট বিরাট সরোবর খনন করে, ক্ষত্রিয়কুলের সমস্ত রক্তে সেগুলি পূর্ণ করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন একজন বিষ্ণুতত্ত্ব।
শ্রীঈশোপনিষদ অনুযায়ী বিষ্ণুতত্ত্ব কখনও পাপকর্ম দ্বারা কলুষিত হন না। ভগবান পরশুরাম সবচেয়ে শক্তিমান ও নিষ্কলুষ হলেও, তিনি আদর্শ চরিত্র প্রদর্শনের জন্য ক্ষত্রিয় বধ রূপ তথাকথিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ সমন্তপঞ্চকে, মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন। এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শ্রীপরশুরাম প্রতিপন্ন, করেছিলেন যে হনন করার কখনও কখনও প্রয়োজন হলেও তা মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর নয়।
ক্ষত্রিয় বধ রূপ পাপ কর্মের জন্য তিনি নিজেকে অপরাধী বলে গণ্য করেছিলেন; তা হলে এইরকম শাস্ত্রবিরুদ্ধ জঘন্য কর্মের জন্য আমরা কতই না অপরাধী।
এইভাবে স্মরণাতীত কাল থেকে জীবহত্যা নিষিদ্ধ হয়ে আসছে। সূর্যগ্রহণের এই উপলক্ষ্যের সুযোগ নিয়ে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তীর্থ দর্শনে গেলেন। তাঁদের মধ্যে কারো কারোর নাম এখানে উল্লেখ করা হল।
বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন
- অক্রুর
- বসুদেব
- উগ্রসেন
কনিষ্ঠদের মধ্যে ছিল
- গদ
- প্রদ্যুম্ন
- সাম্ব
এবং নিজ নিজ কর্তব্য পালন করবার সময় সংঘটিত পাপের, প্রায়শ্চিত্ত করবার উদ্দেশ্যেও অন্যান্য অনেক যাদবরা সেখানে জমায়েত হলেন।
যাদবরা প্রায় সকলেই কুরুক্ষেত্রে চলে যাওয়ায়, পুরী রক্ষার জন্য প্রদ্যুম্ন পুত্র অনিরুদ্ধ, প্রধান যাদব সেনাপতি কৃতবর্মা, সুচন্দ্র, শুক ও সারণকে নিয়ে কয়েকজন
বিশিষ্ট ব্যক্তি দ্বারকায় অবস্থান করলেন। স্বভাবত যাদবরা সকলেই ছিলেন খুব সুন্দর। তবু এই সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে তারা যখন অস্ত্রশস্ত্র, বহু মূল্য বস্ত্রালঙ্কার এবং স্বর্ণ ও পুষ্পমাল্যে যথাযথভাবে ভূষিত হয়ে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য শতগুণ বর্ধিত হল।
দেবতাদের বিমানের মতো ঐশ্বর্যময় সুসজ্জিত বিরাট বিরাট অশ্বচালিত রথে যাদবরা যখন কুরুক্ষেত্রে যাচ্ছিলেন, তখন চলন্ত রথগুলিকে সমুদ্র তরঙ্গের মতো দেখাচ্ছিল। আবার কেউ কেউ যখন সুউচ্চ বলবান হাতিতে চড়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের আকাশ মার্গে ভ্রাম্যমান মেঘের মতো দেখাচ্ছিল। বিদ্যাধরদের মতো সুদেহী বাহকরা সুন্দর সুন্দর পাল্কিতে করে ঐ যাদব-পত্নীদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। যদুকুলের এই বিশাল সমাবেশটি
স্বর্গলোকে দেবতাদের এক বিরাট শোভাযাত্রার মতো দেখাচ্ছিল।
কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী সুসমাহিত চিত্তে যাদবরা সকলে স্নানপর্ব সমাপন করে পাপক্ষালনের উদ্দেশ্যে সূর্যগ্রহণকালে উপবাস পালন করেন। এই উপলক্ষ্যে গো-দান করা বৈদিক প্রথা হওয়ায়, তাঁরা ব্রাহ্মণদের শত শত গাভী দান করেন। এই সব গাভীরা সকলেই বস্ত্রালংকারে সম্পূর্ণ সজ্জিত ছিল। গলায় পুষ্পমাল্য ও পায়ে স্বর্ণময় ঘণ্টা-এই ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য।
পরশুরামের তৈরি হ্রদে যাদবরা সকলে আবার স্নান করলেন। তারপর ঘি-এ তৈরি উপাদেয় ও সুস্বাদু প্রচুর আহার্য দ্বারা তাঁরা ব্রাহ্মণদের আপ্যায়িত করলেন। বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী খাদ্য দু-রকম। একটি জলে সিদ্ধ করা খাদ্য, অন্যটি রান্না করা খাদ্য। সিদ্ধ করা খাদ্যে শাক-সবজি এবং শস্য কাঁচা থাকে না, তাকে জলে সিদ্ধ করা হয়। কিন্তু রান্না করা খাদ্যে সেগুলিকে ঘিয়ে পাক করা হয়। চাপাটি, ডাল, অন্ন এবং সাধারণ শাক-সবজি এইরকম সিদ্ধ করা বা অর্ধপচ্য খাদ্যের পর্যায়ে পড়ে। তেমনই ফল এবং স্যালাড অপচ্য বা কাঁচা খাদ্যের পর্যায়ে পড়ে। প্রথমটি শাক-সবজিবিহীন ও শস্যশূন্য শুধু জলে সিদ্ধ করা, অন্যটি ঘি-এ রান্না করা। চাপাটি, ডাল, অন্ন ও সাধারণ তরকারি হচ্ছে প্রথমটি, যেমন-ফল ও স্যালাড্। কিন্তু পুরী, কচুরী, সিঙ্গাড়া, লাড্ডু প্রভৃতি হচ্ছে রান্না করা খাদ্য। এই শুভ সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে যাদবরা নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের প্রচুর পরিমাণে রান্না করা খাদ্য দ্বারা আপ্যায়িত করলেন।
যাদবদের এই প্রকার ধর্মানুষ্ঠান বাহ্যত সকাম কর্মীদের বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠানের মতো দেখাচ্ছিল। কর্মী যখন কোন বৈদিক ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠান করে, তখন ইন্দ্রিয়তর্পণের জন্য উত্তম পদমর্যাদা, রূপসী স্ত্রী, সুন্দর গৃহ, সু-সন্তান বা প্রচুর ধন-সম্পদ লাভের অভিলাষ করে। কিন্তু যাদবদের অভিলাষ ছিল অন্যরকম-কৃষ্ণের প্রতি অখণ্ড বিশ্বাস ও অনন্য ভক্তিই ছিল তাঁদের একান্ত অভিলাষ। এইজন্য বহু বহু জন্মের সঞ্চিত সুকৃতির ফলে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণ-সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছে। কুরুক্ষেত্র তীর্থক্ষেত্রে স্নান করতে গিয়ে, সূর্যগ্রহণের সময় শাস্ত্রবিধি পালনে বা ব্রাহ্মণ ভোজন ক্রিয়ায়-তাঁদের সকল কাজেই যাদবরা কেবল কৃষ্ণভক্তির কথা ভেবেছিলেন। তাঁদের আরাধ্য ইষ্টদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ, আর কেউ নয়।
ব্রাহ্মণ-ভোজনের পর তাঁদের অনুমতি নিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করা অতিথি সেবকের রীতি। এইজন্য ব্রাহ্মণদের অনুমতি নিয়ে যাদবরা সকলে আহার্য গ্রহণ করলেন। তারপর বিশ্রামের উদ্দেশ্যে ছায়া সুশীতল বিরাট বিরাট বৃক্ষ তাঁরা বেছে নিলেন। যথেষ্ট বিশ্রাম গ্রহণ করবার পর তাঁরা তখন তাঁদের দর্শনাভিলাষীদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন, মিত্রবর্গ, অধীনস্থ বহু রাজা ও শাসকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হলেন। মৎস্য, উশীনর, কোশল, বিদর্ভ, কুরু, সৃঞ্জয়, কাম্বোজ, কেকয় প্রভৃতি অন্যান্য অনেক দেশ-প্রদেশের শাসকরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এইসব শাসকবর্গের কেউ কেউ ছিলেন মিত্র-পক্ষীয়, আবার কেউ কেউ বিরোধীপক্ষের। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ব্রজবাসীরাই ছিলেন সকলের মধ্যে প্রধান। কৃষ্ণ-বলরামের বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে ব্রজবাসীরা জীবন অতিবাহিত করছিলেন। সূর্যগ্রহণকে উপলক্ষ্য করে ও তার সুযোগ নিয়ে সকল ব্রজবাসীরা এসেছিলেন তাঁদের প্রাণ- স্বরূপ কৃষ্ণ ও বলরামকে দেখতে।
ব্রজবাসীরা ছিলেন যাদবদের কল্যাণ-কামী ও অন্তরঙ্গ সুহৃদ; দীর্ঘকাল বিচ্ছেদের পর দু-পক্ষের এই মিলন উৎসব যেমন ছিল খুবই হৃদয়বিদারক, তেমনই ছিল মর্মস্পর্শী। ব্রজবাসী ও যাদবরা মিলিত হয়ে পরস্পর কথোপকথনে যে আনন্দ লাভ করেন তা সত্যি অতুলনীয়। দীর্ঘ বিরহের পর এই মধুর মিলনোৎসবে তাঁরা সকলে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তাঁদের হৃদয় আনন্দে নৃত্য করছিল; তাঁদের দেহে লোমহর্ষ হচ্ছিল; তাঁদের সদ্য বিকশিত কমলবদন থেকে আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল, এবং আনন্দে অভিভূত হয়ে সাময়িকভাবে তাঁরা নির্বাক হয়ে পড়লেন। পক্ষান্তরে বলা যায় তাঁরা সকলে আনন্দ সমুদ্রে নিমজ্জিত হলেন।
উভয়পক্ষের পুরুষরা এইভাবে মিলিত হওয়ায় মহিলারাও একে অপরের সঙ্গে মিলিত হল। স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে মৃদু-মধুর হেসে গভীর অনুরাগভরা মৈত্রীর বন্ধনে তাঁরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করল। এই স্নেহালিঙ্গনে তাদের উভয়ের বক্ষদেশ কুমকুমে আরক্তিম হয়ে উঠল, এবং তাঁরা দিব্য আনন্দ উপভোগ করল। এইরকম সহৃদয় আলিঙ্গনে তাঁদের গণ্ডদেশ অশ্রুপ্লাবিত হল। কনিষ্ঠরা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করল-আর জ্যেষ্ঠরা কনিষ্ঠদের স্নেহাশিস দান করল। এইভাবে তারা পরস্পর একে অপরকে স্বাগত জানিয়ে তাদের কুশল অনুসন্ধান করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণই তাদের কথাবার্তা ও আলোচনার একমাত্র বিষয়ে পরিণত হল। এই ভবসংসারে শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাসের সঙ্গে সকল প্রতিবেশী ও স্বজনই যুক্ত, তাই শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন তাদের সকল কার্যের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা রীতিগত যে কার্যই তাঁরা অনুষ্ঠান করুক-তা সবই ছিল তুরীয় ও অপ্রাকৃত।
মানব জীবনের যথার্থ উন্নতি, যথার্থ প্রগতি, জ্ঞান ও বৈরাগ্যের উপর নির্ভরশীল। এই জন্যই শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে উল্লেখ আছে, কৃষ্ণভক্তির দ্বারা স্বত-ই পূর্ণজ্ঞান ও বৈরাগ্যের উদয় হয়। যাদব ও বৃন্দাবনের গোপদের মন কৃষ্ণে আবিষ্ট ছিল। পূর্ণজ্ঞানের এই হচ্ছে লক্ষণ। কৃষ্ণভাবনায় সর্বদাই তাঁদের মন আবিষ্ট থাকায়, তাঁরা সকলেই জড় কর্মবন্ধন থেকে স্বত-ই মুক্ত ছিলেন। এই অবস্থাকে 'যুক্তবৈরাগ্যময়' জীবন বলে শ্রীল রূপ গোস্বামী অভিহিত করেছেন। তাই জ্ঞান ও বৈরাগ্যের অর্থ শুষ্ক-জ্ঞানচর্চা ও কর্মত্যাগ নয়, পক্ষান্তরে শুধু কৃষ্ণকথা ও কৃষ্ণকর্ম শুরু করা।
দীর্ঘকাল বিচ্ছেদের পর নিজ-নিজ পুত্র, পুত্রবধূ, স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে ভাই-বোন বসুদেব ও কুন্তীদেবী কুরুক্ষেত্রের এই মিলনোৎসবে পরস্পর সাক্ষাৎ করলেন। প্রীতিময় কথোপকথনে অচিরেই তাঁরা অতীত দুঃখের কাহিনী সবই ভুলে গেলেন। কুন্তীদেবী বিশেষভাবে তাঁর ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, "ভ্রাত! আমার দুর্ভাগ্য, কেননা আমার কোন ইচ্ছাই পূর্ণ হল না।
তোমার মতো সর্বগুণান্বিত ও ধার্মিক ভাই থাকা সত্ত্বেও, দুর্দশার সময় তুমি একবারও আমার কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করনি-এমন হয় কখন?” ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনের চক্রান্তে পুত্রগণসহ যখন তিনি নির্বাসিত হন, কুন্তীদেবী সেই দুঃসময়ের কথা স্মরণ করছিলেন বলে মনে হয়। তিনি আরো বলতে লাগলেন, "হে ভ্রাত, আমি বুঝলাম ভাগ্য মন্দ হলে তখন নিকটতম আত্মীয়ও ভুলে যায় স্বজনকে। এই রকম অবস্থায় নিজের পিতা, মাতা ও সন্তানরাও তাকে ভুলে যায়। তাই আমিও ভাই তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি না।"
কুন্তীদেবীর কথার উত্তরে বসুদেব বললেন, "বোন, দুঃখ কর না; এভাবে আমাকে দোষও দিও না। আমাদের মনে রাখা উচিত যে আমরা সকলেই অদৃষ্টের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। সকল সকাম কর্ম ও তার ফল প্রাপ্তি একমাত্র তাঁর নির্দেশের অধীন। ভগিনী, তুমি জান, রাজা কংসদ্বারা আমরা অত্যন্ত নিপীড়িত হই এবং এই নির্যাতনের ফলে ইতস্তত নানাস্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ভগবানের করুণাবশত মাত্র গত কয়েকদিন আগে আমরা স্বগৃহে ফিরে এসেছি।”
কুন্তীদেবী ও বসুদেবের মধ্যে এই কথোপকথনের পর তাঁদের দর্শনপ্রার্থী রাজাদের বসুদেব ও উগ্রসেন স্বাগত জানিয়ে সকলকে সাদর সম্বর্ধনা করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেখানে উপস্থিত দেখে সকল রাজন্যবর্গ পরম শান্তি ও দিব্য আনন্দ লাভ করলেন। সমবেত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকজন হচ্ছে-ভীষ্মদেব, দ্রোণাচার্য, ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন এবং পুত্রবধূ সহ গান্ধারী; মহারাজ যুধিষ্ঠির ও তাঁর পত্নী এবং কুন্তীদেবী ও পাণ্ডবগণ; সৃঞ্জয়, বিদুর, কৃপাচার্য, কুন্তিভোজ, বিরাট, রাজা নগ্নজিৎ, পুরুজিৎ, দ্রুপদ, শল্য, ধৃষ্টকেতু, কাশীরাজ, দমঘোষ, বিশালাক্ষ, মিথিলারাজ, মদ্ররাজ, কেকয়রাজ, যুধামন্যু, সুশর্মা, পুত্রগণ সহ বাহ্লিক এবং মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অধীন অন্যান্য বহু শাসকবর্গ।
তাঁরা সহস্র সহস্র মহিষী সহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেলেন। এইরকম সৌন্দর্য ও দিব্য ঐশ্বর্য দর্শন করে রাজন্যবর্গ পরম তৃপ্ত হলেন। সকলেই ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ভগবান তাঁদের সকলকে যথাযথভাবে স্বাগত জানালে তাঁরা যাদবদের, বিশেষত শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন। ভোজপতি হওয়ায়, উগ্রসেন যাদব প্রধান বলে গণ্য। তাই বিশেষভাবে তাঁকে উপস্থিত রাজন্যবর্গ এই বলে সম্ভাষণ করলেন, “হে মহামান্য ভোজরাজ, বস্তুত ইহলোকে একমাত্র যাদবদের জীবনই সর্বতোভাবে সফল। আপনাদের জয় হউক! আপনাদের জয় হউক!
আপনাদের এই সাফল্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, আপনারা সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করছেন, যাঁকে লাভ করবার জন্য যোগীরা বহুকাল ধরে কৃচ্ছসাধন ও কঠোর তপশ্চর্যা করে চলেন। প্রতি মুহূর্তে আপনারা সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
"বেদের সকল মন্ত্রই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা ও গুণ কীর্তনে পূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণের পাদোদক হওয়ায় গঙ্গা সারা বিশ্ব পবিত্রকারিণী বলে গণ্য। বৈদিক শাস্ত্রগুলি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুশাসন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কৃষ্ণকে জানাই হল বেদ অধ্যয়নের উদ্দেশ্য। এই জন্য কৃষ্ণের কথা ও কৃষ্ণলীলা সমূহের শিক্ষা সর্বদা সকলকে পবিত্র করে। কাল ও পরিস্থিতির প্রভাবে জগতের সকল ঐশ্বর্যই ক্ষয় ও বিনাশ প্রাপ্ত হয়, কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে, তাঁর পাদপদ্মের স্পর্শে সকল শুভ ও মঙ্গলের প্রকাশ ঘটতে থাকে। তাঁর উপস্থিতির ফলে আমাদের সকল ইচ্ছা ও অভিলাষ সবই ক্রমশ পূর্ণ হতে চলেছে। হে মহামান্য ভোজরাজ, আপনি যদুবংশের সঙ্গে বৈবাহিক ও জন্মসূত্রে সম্বন্ধযুক্ত। তার ফলে আপনি সবসময় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত। যে কোন সময় কৃষ্ণ দর্শন আপনার পক্ষে কঠিন নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপনার সঙ্গে চলাফেরা করেন, কথাবার্তা বলেন, উপবেশন করেন, বিশ্রাম করেন এবং আহার করেন। যাদবরা সর্বদাই বিষয়কর্মে নিযুক্ত বলে মনে হলেও এবং যার ফল নিশ্চিতভাবে অধোগতি, কিন্তু বিষ্ণুতত্ত্ব, আদি পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপ্ত, সর্বশক্তিমান তাঁর উপস্থিতিতে আপনারা সকলেই বস্তুত সকল জড় কলুষতা মুক্ত ও দিব্য ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত।”
সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হবেন, এ কথা শুনে নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে ব্রজবাসীরাও সেখানে যেতে মনস্থ করলেন। তাই যাদবরাও সকলে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। নিজ গোপগণদের সঙ্গে নিয়ে নন্দ মহারাজ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ দিয়ে গো-যান বোঝাই করলেন। তাদের পরম প্রিয় কৃষ্ণ ও বলরামকে দেখবার জন্য সকল ব্রজবাসীরা কুরুক্ষেত্রে গমন করলেন। ব্রজবাসীরা কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলে যাদবরা সকলেই খুব খুশি হলেন। তাদের দর্শনমাত্র যাদবরা দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানালেন, মনে হল তাঁরা যেন পুনর্জীবন লাভ করলেন। পরস্পর মিলনে উন্মুক্ত যাদব ও ব্রজবাসীরা বস্তুত যখন কাছে এসে সাক্ষাৎ করলেন, তখন অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাঁরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে কিছু সময় ঐ অবস্থায় রইলেন।
নন্দ মহারাজকে দেখামাত্র আনন্দে উল্লসিত হয়ে লাফ দিয়ে দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে, গভীর অনুরাগভরে বসুদেব তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। বসুদেব তাঁর জীবনের পূর্বের কাহিনী বলতে লাগলেন-কিভাবে কংস তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল, কিভাবে তাঁর শিশু সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল, কৃষ্ণের জন্মের পরই কিভাবে তাঁকে নন্দ মহারাজের গৃহে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এবং কিভাবে কৃষ্ণ ও বলরাম মহারাজ নন্দ ও তাঁর রাণী দ্বারা তাঁদের সন্তানদের মতো লালিত পালিত হয়েছিলেন। সেইরকম কৃষ্ণ-বলরামও নন্দ মহারাজ ও মাতা যশোদাকে আলিঙ্গন করলেন এবং অবনত হয়ে তাঁদের চরণকমলে প্রণাম জানালেন। পিতামাতার প্রতি সন্তানের অনুরাগবশত কৃষ্ণ ও বলরাম দুজনেরই কয়েক মুহূর্তের জন্য কণ্ঠরুদ্ধ হল, তাঁরা কথাই বলতে সক্ষম হলেন না। সবচেয়ে ভাগ্যবান মহারাজ নন্দ ও মাতা যশোদা পুত্রদ্বয়কে কোলে তুলে নিয়ে পরম স্নেহে তাঁদের আলিঙ্গন করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের বিরহে মহারাজ নন্দ ও মা যশোদা দীর্ঘদিন গভীর দুঃখতাপে নিমগ্ন ছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে মিলনে ও আলিঙ্গনে সকল দুঃখতাপে উপশম হল।
এরপর কৃষ্ণের মা দেবকী ও বলদেবের মা রোহিণী দুজনেই মা যশোদাকে আলিঙ্গন করলেন। তাঁরা বললেন, "রাণী যশোদা দেবী, তুমি ও মহারাজ নন্দ দুজনে আমাদের পরম বন্ধু, এবং তোমাদের বন্ধুসুলভ কার্যাবলীর কথা ভেবে, তোমাদের স্মরণ হওয়া মাত্রই আমরা তৎক্ষণাৎ অভিভূত হই। তোমাদের বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য এমনকি স্বর্গরাজ্যের সমস্ত ঐশ্বর্য তোমাদের উপহার দিয়েও আমরা তোমাদের ঋণ শোধ করতে অক্ষম। আমরা তোমাদের কাছে এমনভাবেই ঋণী যে, তোমাদের এই সদয় ব্যবহার আমরা কখনও ভুলব না। কৃষ্ণ ও বলরাম যখন জন্মগ্রহণ করল, তাদের আসল পিতামাতাকে দেখার আগেই তাদেরকে তোমাদের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। পাখি যেমন নিজ শাবকগুলির লালনপালন করে, নিজ সন্তানের মতো তোমরাও প্রীতি ও স্নেহ দিয়ে সযত্নে তাদেরকে বড় করে তুলেছ। তোমরা সুখাদ্য আহার দিয়ে তাদের দেহের পুষ্টিসাধন করে তাদের প্রীতি সাধন করেছ, এবং তাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বহু শুভ ধর্মীয় পর্ব অনুষ্ঠান করেছ।
"বস্তুত কৃষ্ণ-বলরাম আমাদের সন্তান নয়; তারা তোমাদেরই; নন্দ মহারাজ ও তুমিই তাদের যথার্থ পিতা-মাতা; যতদিন কৃষ্ণ-বলরাম তোমাদের দ্বারা লালিত- পালিত হয়েছে, ততদিন তাদের সামান্যতমও অসুবিধা হয়নি। তোমাদের প্রযত্নে সবরকম ভয় ও বিপদ থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল।
তোমাদের মতো মহানুভব ব্যক্তিদের পক্ষেই এই পরম স্নেহময় লালন পালন সম্ভব। সর্বশ্রেষ্ঠ মহাত্মারা নিজ সন্তান ও অপরের সন্তানদের মধ্যে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করেন না; এবং নন্দ মহারাজ ও তোমার থেকে অধিকতর কোন মহান ব্যক্তি আর কেউ হতে পারে না।"
শ্রীকৃষ্ণ বলরাম ও ব্রজগোপিদের ছবি |
বৃন্দাবনের ব্রজগোপিকারা তাঁদের জীবনের সূচনা থেকেই কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই জানতেন না। কৃষ্ণ-বলরামই তাঁদের জীবন। গোপীরা কৃষ্ণের প্রতি এতই আসক্ত ছিলেন যে চোখের পাতার দ্বারা দর্শনে বাধা প্রাপ্ত এক মুহূর্তের অদর্শনও তাঁরা সহ্য করতে পারতেন না। গোপীরা তাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিন্দা করতেন; কেননা তিনি যে চোখের পাতা সৃষ্টি করেছেন, তা পিটপিট করার ফলে কৃষ্ণদর্শনে বাধা সৃষ্টি করতো। বহু বছর বিরহের পর নন্দ মহারাজ ও মা যশোদার সঙ্গে এসে কৃষ্ণকে দর্শন করে গোপীরা গভীর আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন। কৃষ্ণদর্শনের জন্য গোপীদের এই ব্যাকুলতা কেউ কল্পনা করতে পারে না। দৃষ্টিপথে আসা মাত্রই গোপীরা দর্শনের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে তাঁদের হৃদয়ের অন্তস্তল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে তাঁকে আলিঙ্গন করেন।
মনে মনে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেও তাঁরা আনন্দে এতই উৎফুল্ল ও অভিভূত হয়ে পড়েন যে সাময়িকভাবে তাঁরা নিজেদেরকে ভুলে যান। শুধু মনে মনে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে গোপীরা যে আনন্দময় সমাধি লাভ করেন, তা সর্বদা পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যানে নিমগ্ন শ্রেষ্ঠ যোগীদের কাছে সুদুর্লভ। তাই কৃষ্ণ হৃদয়ঙ্গম করলেন যে মানসিকভাবে তাঁকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে গোপীরা দিব্য আনন্দে ভাবাবিষ্ট এবং যেহেতু তিনি সকলের হৃদয়াভ্যন্তরে বিরাজিত, সেহেতু কৃষ্ণও তাঁদের সকলকে আলিঙ্গন দান করলেন। মা যশোদা, দেবকী ও রোহিণীর সঙ্গে বসে থাকার সময় যখন কথোপকথনে নিমগ্ন, তখন সেই সুযোগে কৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার উদ্দেশ্যে এক জনহীন স্থানে যান।
তাঁদের কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি হাসতে শুরু করেন এবং তাঁদের আলিঙ্গন করে ও কুশলবার্তা অনুসন্ধান করে, তিনি এই কথা বলে তাঁদের উৎসাহ দান করতে থাকেন- "প্রিয় সখীরা, তোমরা সকলে জান যে আমাদের স্বজন পরিবারের সকলকে তুষ্ট করবার জন্যই বলরাম ও আমি বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যাই। এইভাবে দীর্ঘকাল আমাদের শত্রুদের সঙ্গে নিযুক্ত হয়ে তোমাদের কথা ভুলে যেতে আমরা বাধ্য হই, যদিও তোমরা প্রীতি ও অনুরাগ ভরে আমার প্রতি খুবই অনুরক্ত। আমি বুঝতে পারছি যে এই কাজের মাধ্যমে আমি তোমাদের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি, তবুও আমি জানি তোমরা আমার প্রতি বিশ্বাসভাজন। আমি তোমাদের কাছে জানতে পারি কি, আমরা তোমাদের পরিত্যাগ করে এলেও তোমরা আমাদের কথা ভাবছিলে কি না? প্রিয় সখীরা, তোমাদের প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ায়, এখন কি আমার কথা চিন্তা করতে তোমাদের আর ইচ্ছা হয় না? আমার এই রকম দুর্ব্যবহার তোমরা কি ঐকান্তিকভাবে গ্রহণ করেছ?
আরো পড়ুন:- শ্রীমতি রাধারানী কে এবং রাধা নামের মাহাত্ম্য!
"যাই বল না, তোমাদের পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছা-ই আমার ছিল না। পরম নিয়ামকের যেমন ইচ্ছা সেইভাবে তিনি সব কিছু করেন। তাই আমাদের এই বিচ্ছেদ বিধির বিধান। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির মিলন ঘটান ও স্বেচ্ছায় তাদের বিচ্ছিন্ন করেন। কখনও কখনও আমরা দেখি যে মেঘ ও প্রবল বাতাসের উপস্থিতির ফলে অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুলাখণ্ড একসঙ্গে মিলিত হয়। সেই ঝড় থেমে গেলে ধূলিকণা ও তুলাখণ্ডগুলি আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পরমেশ্বর ভগবান সব কিছু সৃষ্টি করেন। দৃশ্যমান সব কিছুই তাঁর শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ। তাঁর অন্তিম ইচ্ছার ফলে কখনও কখনও আমরা পরস্পর মিলিত হই এবং কখনও কখনও আমরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি, পরিশেষে আমরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছার ওপরই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
"সৌভাগ্যবশত তোমরা আমার প্রতি অনুরাগের বিকাশ ঘটিয়েছ-যা আমার দিব্য সান্নিধ্য লাভের একমাত্র উপায়। আমার অনন্য ভক্তি বিকাশ করে যে কোন জীব জীবন অবসানে অবশ্যই বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে পারে। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, আমাতে অনন্য ভক্তি ও অনুরাগ হচ্ছে অন্তিম মুক্তির কারণ।
"প্রিয় সখীরা, তোমরা জেনে নাও যে আমার শক্তিগুলিই সর্বত্র ক্রিয়া করছে। যেমন একটি মৃৎপাত্রের কথাই ধরা যাক্। এটি মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশের সমন্বয় মাত্র। প্রারম্ভিক স্তরে, স্থিতিকালে বা ধ্বংসের পরও-সকল অবস্থায় সর্বদাই এটি প্রাকৃতিক উপাদানের সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছু নয়। নির্মাণের সময় পাত্রটি মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ দিয়ে তৈরি ছিল; স্থিতিকালে দৈহিক সংগঠনে এটি একই থাকে; তারপর এটি ভেঙ্গে ধ্বংস করা হলে, এর বিভিন্ন উপাদানগুলি জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন অংশে সংরক্ষিত হয়। সেই রকম এই বিশ্ব সৃষ্টির সময়, পালনের সময় এবং প্রলয়ের পর, অর্থাৎ সবকিছুই আমার শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। শক্তি আমা থেকে ভিন্ন নয়। তাই আমি সবকিছুতেই বিরাজ করছি-এই হচ্ছে সিদ্ধান্ত।
"ঠিক সেইরকমভাবে জীবদেহও পঞ্চভূতের সমন্বয় ছাড়া কিছুই নয়। এই জড় জগতে জড় শরীরে আবদ্ধ জীবসকল হচ্ছে আমার অংশ। জীবাত্মার এই জড় জগতে তার মিথ্যা অহংকাররূপ ভোক্তা অভিমানই হচ্ছে তার সংসার কারাগারে আবদ্ধ হওয়ার কারণ। পরম সত্য-আমি, জীব ও তার জড় বন্ধন উভয়ের ঊর্ধ্বে। জড় ও চিৎ দুটি শক্তিই আমার নির্দেশে ক্রিয়াশীল। প্রিয় গোপিকারা, আমার একান্ত অনুরোধ, এত বিরহ কাতর না হয়ে, সবকিছুই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তোমরা গ্রহণ করবার চেষ্টা কর। যখন তোমরা হৃদয়ঙ্গম করবে যে তোমরা সর্বদাই আমার সান্নিধ্যে বিরাজ করছ, তখন আর আমাদের পারস্পরিক বিচ্ছেদ ও শোকের কোনই কারণ থাকবে না।"
গোপীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এই গুরুত্বপূর্ণ উপদেশগুলি কৃষ্ণানুশীলনকারী সকল ভক্তরাই ব্যবহার করতে পারেন।' সমগ্র তত্ত্বদর্শনই অচিন্ত্য-ভেদাভেদ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিক্ষা দিয়েছেন যে, তাঁর অব্যক্ত মূর্তিতে তিনি সর্বত্রই বিরাজিত আছেন। দৃশ্যমান সৃষ্টি ভগবানের শক্তির একটি প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন কৃষ্ণভাবনার এই পূর্ণ জ্ঞানের অভাব হয়, তখন আমরা কৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন হই। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এই কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করলে, আমরা কৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন হব না-তখন কৃষ্ণের সান্নিধ্যেই আমরা বিরাজ করব। ভক্তির পথ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পুনর্জাগরণের পথ। ভাগ্যবান কৃষ্ণানুশীলনকারী যদি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে জড়া প্রকৃতি শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভিন্ন নয়, তখন সে জড়া-প্রকৃতি ও জড়া প্রকৃতি জাত দ্রব্য কৃষ্ণসেবায় নিয়োগ করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, কৃষ্ণভক্তিহীন ও কৃষ্ণবিস্মৃত জীব নিজেকে ভোক্তা অভিমান করে এবং জড়া প্রকৃতি দ্বারা এইভাবে জড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার ভ্রমণে বাধ্য হয়। এই তত্ত্ব ভগবদ্গীতায়ও প্রতিপন্ন হয়েছে। জড়া প্রকৃতির অধীনে কার্য করতে বাধ্য হলেও, জীব নিজেকে সর্বময় কর্তা ও ভোক্তা বলে মিথ্যা অভিমান করে থাকে।
ভক্ত যদি যথাযথভাবে জানতে পারে যে মন্দিরে ভগবান কৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহ বা অর্চাবিগ্রহ স্বয়ং কৃষ্ণের মতোই সৎ, চিৎ ও আনন্দঘন, তা হলে তার শ্রীবিগ্রহসেবা পরমেশ্বর ভগবানের সাক্ষাৎ সেবায় পরিণত হয়। সেই রকমভাবেই কৃষ্ণমন্দির ও মন্দিরের অন্যান্য সব উপকরণ এবং কৃষ্ণপ্রসাদও কৃষ্ণ থেকে অভিন্ন। বৈষ্ণবাচার্যগণ প্রদত্ত নিয়ম-কানুন পালন করা উচিত এবং এইভাবে সাধু-গুরুর আনুগত্যে সংসারে আবদ্ধ অবস্থায়ও কৃষ্ণোপলব্ধি সম্পূর্ণ সম্ভব। অচিন্ত্য-ভেদাভেদ তত্ত্বদর্শনের শিক্ষা শ্রীকৃষ্ণের কাছে পেয়ে গোপীরা সব সময় কৃষ্ণভাবনায় নিমগ্ন হলেন এবং এইভাবে তাঁরা সমস্ত জড় কলুষতা থেকে নির্মুক্ত হলেন। জড় জগতের মিথ্যা ভোক্তাভিমানী জীবাত্মার ভাবনাকে জীবকোষ বলে,
অর্থাৎ জড় অহংকারে আবদ্ধ থাকা। শুধু গোপীরা নয়, যে কেউ শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ পালন করবে, সে অচিরেই জীবকোষের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। পূর্ণ কৃষ্ণানুশীলনে নিযুক্ত জীব সর্বদাই জড় অহংকার মুক্ত। সেই কৃষ্ণভক্ত তার সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করে এবং সে কখনই শ্রীকৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না-সব সময় কৃষ্ণসান্নিধ্যে সে বিরাজ করে।
এইজন্য গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করে বললেন, "হে কৃষ্ণ, তোমার নাভিজাত মূল পদ্ম হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জন্মস্থান। হে কৃষ্ণ, তোমার মহিমা ও ঐশ্বর্য অপরিমেয়; তাই যোগসিদ্ধ মনীষীদের কাছেও তা সর্বদাই রহস্যাবৃত। কিন্তু সংসার-কূপে পতিত মায়াবদ্ধ জীবাত্মা অতি সহজেই তোমার চরণকমলে শরণাগত হতে পারে। তখন নিঃসন্দেহে সে উদ্ধার পাবে।” গোপিকারা আরো বলে চললেন, “হে কৃষ্ণ, আমরা সবসময় গৃহকর্মে ব্যাপৃত। তাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা এই যে, উদীয়মান সূর্যের মতো তুমি আমাদের হৃদয়ে বিরাজিত হও, আর সেইটিই হবে আমাদের প্রতি তোমার পরম আশীর্বাদ।"
গোপিকারা নিত্যমুক্ত জীবাত্মা, কেননা তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ কৃষ্ণভাবনাময়। তাঁরা বৃন্দাবনে শুধু গৃহকর্মের মায়ায় আবদ্ধ হওয়ার ভান করতেন মাত্র। কৃষ্ণবিরহে কাতর ব্রজগোপিকারা কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর রাজপুরী দ্বারকায় যেতে উৎসাহী ছিলেন না। বৃন্দাবনে কৃষ্ণভজনে নিযুক্ত থাকতেই তাঁরা পছন্দ করতেন, এবং এইভাবে তাঁরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কৃষ্ণের উপস্থিতি অনুভব করতেন। তাঁরা অচিরেই শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরে আসতে আমন্ত্রণ জানান।
গোপিকাদের এই দিব্য- ভাবোন্মাদনাময়ী ভগবদ্ভজনই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল শিক্ষা। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কর্তৃক রথযাত্রার লীলাবিলাস হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনার উদ্দীপক। দ্বারকার রাজকীয় ঐশ্বর্যপূর্ণ পরিবেশে কৃষ্ণসান্নিধ্য আস্বাদনের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যেতে শ্রীমতী রাধারাণী অস্বীকৃত হন, কিন্তু বৃন্দাবনের মাধুর্যময় পরিবেশে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গসুখ কামনা করেন। গোপীদের প্রতি গভীর অনুরাগ-সম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণ কখনও বৃন্দাবন পরিত্যাগ করে যান না, আর গোপী ও ব্রজবাসীরা বৃন্দাবনে কৃষ্ণভজন করে সর্বদাই সন্তুষ্ট থাকেন।
সমাপ্ত
Hindu Express points এই আর্টিকেলটি কেমন লেগেছে তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ।
আরো পড়ুন:- ভগবান বিষ্ণু এবং গজেন্দ্র হাতির গল্প!
আরো পড়ুন:- আসুন রাধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কে এমন ৬ টি জিনিস জেনে নি, যা প্রতিটি সত্যিকারের প্রেমিক দম্পতির জানা উচিত।
0 মন্তব্যসমূহ